রবিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৫
আওয়ামী-লীগ নেতাদের হাতে রেখে বিক্রি হতো এলিট কর্পোরেশনের মরণব্যাধি হারবাল পন্য

উদ্যোক্তা তৈরির আড়ালে মরণব্যাধি হারবাল পন্য বিক্রি করছে জি এম আই টি

এলিট কর্পোরেশনের নামে সিএমপি, বিএসটিআই, বাংলাদেশ সাইন্সল্যাব ও ওষুধ প্রশাসনের জাল ছাড়পত্র তৈরি করে মার্কেটিং করছে জিএমআইটি

আব্দুল্লাহ আল নোমান শুভ

প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৫:০২ পিএম

উদ্যোক্তা তৈরির আড়ালে মরণব্যাধি হারবাল পন্য বিক্রি করছে জি এম আই টি

আধুনিক যুগে অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক ও টিকটক জুড়ে ভুয়া প্রোডাক্ট এর মার্কেটিং যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে। এর নজরদারিতে নেই প্রশাসনের কোন উদ্যোগ। সোশ্যাল মিডিয়া টিকটক সেলিব্রেটিদের দিয়ে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন তৈরি করে ক্রেতাদের আকর্ষণ বাড়িয়ে আয়ুর্বেদিক ও হারবাল ওষুধের কথা বলে সাধারন মানুষদের প্রতারণার স্বীকার করছে বেশ কয়েকটি চক্র।

 

এলিট কর্পোরেশনের মরণব্যাধি হারবাল পণ্য বিক্রির মুলহোতা কামরুল কায়েস চৌধুরী। যার একটি নিজস্ব আইটি ফার্ম "জি এম আইটি" নামে পরিচিত। এই জিএমআইটিতে উদ্যোক্তা তৈরি নামে নাবালক ছেলে-মেয়েদেরকে দিয়ে এইসব ক্ষতিকারক ওষুধ বিক্রি করানো হয়।

 

এসব চক্রের প্রতারণার প্রথম ধাপ হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরীর নামে জি এম আইটি কোর্স বুলেটপ্রুফ মার্কেটিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং করতে হলে পণ্যগুলো সোর্সিং লাগবে। সে কথা বলে এলিট কর্পোরেশনের মরণবাদী ঔষধ বিক্রি করাছেন সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্লাটফর্মে।

 

চক্রটির প্রতারনার দ্বিতীয় ধাপে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর যেমন, বিএসটিআই, বাংলাদেশ সাইন্সল্যাব, ওষুধ প্রশাসন, সিএমপি, খাদ্য অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন দপ্তরের জাল ও ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। এরপর ভোক্তার হাতে তুলে দেয়া হয় এলিট কর্পোরেশনের বিষাক্ত ও মরণবাদী ওষুধ গুলো। 

 

তৃতীয় ধাপে তাদের পছন্দের বিষয়টি হলো রাজনীতিবিদদের, সরকারি কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সেলিব্রেটিদের দিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন ও বিজ্ঞাপন তৈরি করা। তার মধ্যে বেশিরভাগই হলো টিকটকার যারা আসলেই জানে না এ পণ্যটি দেশীয় কোন প্রতিষ্ঠানে লাইসেন্স অথবা ক্ষতিকর দিক গুলো সম্পর্কে। শুধুমাত্র লোভনীয় অর্থ দিয়ে এসব বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়। তার মধ্যে রয়েছেন নামি দামি বিভিন্ন সেলিব্রিটি। 

 

চতুর্থ ধাপে তারা এ বিজ্ঞাপনগুলো যাদেরকে দিয়ে তৈরি করেন, তাদের ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক আইডিতে ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন গুলো মার্কেটিং করানো হয়। যাতে দেশের সাধারণ জনগণের মরণব্যধি ওষুধগুলো সেবন করাতে পারে। 

 

পঞ্চম ধাপে ক্রেতাদের হাতে এসব ওষুধ বা পণ্য পৌঁছিয়ে দিতে বিভিন্ন ধরনের কুরিয়ার সার্ভিস যেমন পাঠাও, স্ট্রীট ফার্স্ট, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান কে ব্যবহার করে তারা। এতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

 

চট্টগ্রাম নগরীর ৯নং ওয়ার্ড, পশ্চিম কুয়াইশ চৌধুরী বাড়িতে এলিট কর্পোরেশনের হারবাল পন্য তৈরির একটি ফ্যাক্টরি ছিল এবং সেখানে বিভিন্ন হারবাল প্রোডাক্ট তৈরী করা হতো। গত ২০২৩ সালের জুন মাসে একটি অভিযান পরিচালনা করে মেজিষ্ট্রেট এসে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু একটি ফ্যাক্টরী বন্ধ হলেও বিভিন্ন জায়গায় এখনো গোপন ফ্যাক্টরী করে ঔষধ গুলো তৈরি করছে এলিট কর্পোরেশন। 

 

২০২৩ সালে আগষ্ট মাসের ৩ তারিখ বিপুল পরিমাণ ভেজাল হারবাল ঔষধ ও নকল প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রির দায়ে চট্টগ্রাম মহানগর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ ডিবি (উত্তর ও দক্ষিন) এসব বিষাক্ত পণ্য উদ্ধার সহ গ্রেফতার করে ৭ জনকে। সিএন্ডবি কলোনীর বিপরীত পাশের অফিস থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, মো. আইয়ুব হেলালী, আদর চৌধুরী ওরফে হিমু , মো. শরীফ হাসান , মো. সরোয়ার হোসেন , মো. ইমরানুল হক, আব্দুর রহমান এবং আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল ইমন।

 

পরবর্তীতে আবারো ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকায় ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে উঠে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবির)। ডিবির সুপরিকল্পিত ফাঁদে ভুয়া আয়ুর্বেদিক ও হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ' এলিট কর্পোরেশন ' এতে কোন গ্রেফতারের তথ্য না থাকলেও বিপুল পরিমান ঔষধ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত মালামাল পূর্বের মামলায় দেখানো হয়। 

 

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, তৎকালীন আওয়ামী সরকার থাকাকালীন চট্টগ্রামের আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তার ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছিল তার মধ্যে একজন ষোলকবহর ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোরশেদ আলমকে জিএমআইটির উপদেষ্টা হিসাবে রাখা হয়। এরপর পাঁচলাইশ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছিল। আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর এই জিএমআইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল কায়েস গিরগিটির মত রং পাল্টিয়েছে। এটিও তার প্রতারণার একটি কৌশল। জি এম আই টি ও এলিট কর্পোরেশন এর এমএলএম এর ফাঁদে পড়ে আমি ও আমার সহকর্মীদের অনেক অর্থের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমরা এখন পথে ভিখারীর মতোই। 

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে আসলেই কি এসব ব্যবসা বন্ধ হবে না? আমি এ কোম্পানির একজন তৎকালীন কর্মী থাকায় আমি জানি এসব ওষুধের কতখানি ক্ষতি। ওষুধ প্রশাসনের কোনই দৃষ্টিপাত নেই এই ভুয়া ওষুধগুলোর দিকে? আরো অনেক প্রশ্ন মনে জাগে কিন্তু সাহস পাচ্ছি না তার বিষয়ে কথা বলার কখন না আবার তুলে নিয়ে যায় তার টর্চারশেলে। 

 

তিনি আরো জানান, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে যে পত্রিকায় এলিট কর্পোরেশনকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা হয়েছে সে পত্রিকার সম্পাদক কে অর্থের বিনিময়ে সংবাদের প্রতিবাদ করিয়ে দিতেন। স্বৈরাচারীর হাসিনা সরকার আমলে পত্রিকা গুলো এমন ছিল প্রথম পেজে তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও পত্রিকার শেষ পেজে থাকতো তারই প্রতিবাদ। পরবর্তীতে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ওই সম্পাদকের একটি পত্রিকার উপদেষ্টা ও আরেকটি পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান কামরুল কায়েস। এভাবে আর কতো জীবনকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে? আমি ভুক্তভোগী হিসেবে জোর দাবি রাখবো মরনব্যাধি হারবাল পন্যগুলো যেনো বন্ধ করা হয়।

 

এদিকে, ২০২৪ সালে অভিযানের পর তার পণ্য বিক্রির ধরন একটু পাল্টিয়েছে যেমন, পন্যের মোরক পরিবর্তন, পণ্যের নাম পারিবর্তন। কিন্তু পণ্যগুলোর মোরক পাল্টালেও ভিতরের পন্যের ধরন রয়ে গেছে একই।

 

২০১৪ বাংলাদেশ বিজ্ঞাপন নীতিমালা আইন অনুযায়ী, চতুর্থ অধ্যায়ের ৪.৩.৪ অনুচ্ছেদে বর্ণনা আছে যে শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা বা দৈহিক আকার ও বর্ণকে কেন্দ্র করে কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। 

৪.৪.৪ অনুচ্ছেদ আরও বর্ণনা করা আছে যে কোন খাদ্য বা পানীয় এর বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যগত প্রভাব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং সুপার ইম্পোজ করে স্পষ্টাক্ষরে দেখাতে হবে। নীতিমালা আইন ও অনুসন্ধানে গোপন সূত্র পাওয়ার তথ্যের সাথে এলিট কর্পোরেশনে কার্যক্রমের কোন মিল পাওয়া যায়নি। ভোক্তার বিশ্বস্ততা অর্জন করতে প্রতারণার অনেকগুলো ধাপ পার করেছেন যেমন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপির) কোন ছাড়পত্র দেয়ার নিয়ম না থাকলেও তিনি নিজের তৈরি করে সেটি মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে প্রদর্শন করছে। শুধু তাই নয় নিজেই তৈরি করেছেন বিভিন্ন জাল টেস্ট রিপোর্ট, বিএসটিআই ছাড়পত্র ও বাংলাদেশ সাইন্সল্যাব এর ছাড়পত্র।

 

চট্টগ্রাম (বিএসটিআই) সহকারী পরিচালক নিখিল রায় বলেন, আমাদের ২৯৯ টি পণ্যের তালিকায় এই পণ্য বা ওষুধ একটিও নেই। বিএসটিআই এর ছারপত্র পাওয়া এত সহজ বিষয় নয়। যে কেউ এসে চাইলেই সেটা আমরা দিয়ে দিতে পারিনা। তাদের বিজ্ঞাপনে বিএসটিএ সার্টিফাইড বলার বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।