সোমবার, এপ্রিল ২৮, ২০২৫
logo

প্রতিযোগিতা কমিশন থাকলেও দেশের কোথাও প্রতিযোগিতা নেই


মিরহাজুল শিবলী প্রকাশিত:  ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১২:০২ এএম

প্রতিযোগিতা কমিশন থাকলেও দেশের কোথাও প্রতিযোগিতা নেই

* আইন থাকলেও প্রয়োগের লক্ষণ নেই

* ভাঙা যাচ্ছে না সিন্ডিকেট

* আইনি প্রক্রিয়ার অজুহাতে কাজে মন্থরগতি


নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে ক্রেতাদের হতাশার গল্প পুরোনো। কোনোভাবেই যেন দ্রব্যমূল্য নাগালে আসছে না সাধারণ মানুষের। ঘুরে ফিরে দায় যায় সিন্ডিকেটের ওপর। কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বাজার। আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে সেই শঙ্কা বেড়েছে। সিন্ডিকেটের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ক্রেতা ও বিক্রেতারা। পকেট ভরছে রাঘব-বোয়ালদের। তবে রাঘব-বোয়ালদের ধরার দায়িত্ব সরকারের যে প্রতিষ্ঠানের, তাদের নেই কোনো কার্যক্রম। তাদের নিজস্ব আইন থাকলেও নেই তার প্রয়োগ। জনবল সংকটে ভোগা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি চলছে প্রাণহীন সত্ত্বার মতো!
কমিশন সূত্রে জানা যায়, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অসম প্রতিযোগিতা হ্রাস করে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন, প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে সাধারণ মানুষের পণ্য ও সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ এবং পণ্যে সর্বোচ্চ উপযোগ পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনে উদ্ভাবন আনয়নের জন্য বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থনীতিতে টেকসই প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাজারে সমতা আনা, ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষা এবং বাজারে উত্তম চর্চা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা কমিশনের সূচনা হয়। একই বছর ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহারে রোধ, যৌথবদ্ধতা যা দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করে, এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে নির্মূল করার জন্য ৪৬টি ধারা সম্বলিত প্রতিযোগিতা আইন তৈরি করা হয়।
কমিশনের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে দুটি মামলার মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে প্রতিযোগিতা কমিশন। ওই মামলা কিছু নির্দেশনা দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর ২০১৯ সালে কোনো মামলা না হলেও ২০২০ সালে ৯টি, ২০২১ সালে ৪টি, ২০২২ সালে ৬৫টি, ২০২৩ সালে ১৪টি এবং চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে চাল ও করপোরেট চাল ব্যবসা সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ২০টি। এর বাইরে গত বছর থেকে বাজারের সবচেয়ে আলোচিত ডিম সংক্রান্ত ১৭টি, ভোজ্যতেল সংক্রান্ত ৯টি, মুরগি সংক্রান্ত ৬টি, আটা ও ময়দা সংক্রান্ত ৮টি, টয়লেট্রিজ সংক্রান্ত ৮টি, ই-কমার্সের ৯টি এবং পেঁয়াজ সংক্রান্ত মামলা করা হয়েছে একটি। এছাড়া ২৮টি কোল্ড স্টোরেজের বিরুদ্ধে আলু নিয়ে জটিলতায় ৩টি, অনলাইন ফুড ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি বিষয়ে ৩টি, বোতলজাত পানি সংক্রান্ত একটি এবং অন্যান্য বিষয়ে মামলা হয়েছে ২০টি।
কাজে মন্থরগতির দায় স্বীকার করে নেন প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. আফরোজা বিলকিস। তিনি আজকের বাংলাকে বলেন, আমাদের কমিশনের কার্যক্রম সরকারের অন্য দপ্তরের চেয়ে একটু ভিন্ন। আমরা বিচারিক প্রক্রিয়ায় কাজ করে থাকি, সেজন্য বিচারপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ আইন মেনে শেষ করতে একটু সময় লাগে। আর বর্তমান কমিশন মাত্র দেড় মাস ধরে গঠিত হয়েছে। আগের কমিশন কিছু মামলা বিভিন্ন কারণে নিষ্পত্তি করেনি। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। বেশ কিছু মামলার বিষয়ে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে পৌঁছেছি।
আসন্ন রমজানে সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। যদি এবারের রমজানে সেরকম তৎপরতা আমরা দেখি, আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এছাড়া আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। সেটি নিয়েও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জনবল সংকট কাটিয়ে উঠলে কমিশনের সক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিশন একটি বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। এ কমিশনে নেই আইন বিশেষজ্ঞ, নেই অর্থনীতিবিদ। বিশেষজ্ঞ জনবলের অভাবে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না এই কমিশন। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই কমিশনের বিরুদ্ধে বেআইনি কাজ ও ব্যবসায়ীদের অযথা হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর দু-একটি নামসর্বস্ব কাজ করেই দায় সারেন কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, উক্ত অর্থবছরে প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের কারণে কমিশন স্বপ্রণোদিতভাবে ৪৮টি মামলা রুজু করে এবং অভিযোগের ভিত্তিতে ৬টি মামলা গ্রহণ করে। নথি ঘেঁটে জানা যায়, উক্ত অর্থবছরের শেষদিন পর্যন্ত কমিশনের নিকট মামলা সংখ্যা ছিলো ৬৬। এর মধ্যে শুনানি পর্যায়ে ৪৭টি এবং তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ছিলো ১৯টি।
সারাবছর কার্যক্রম চালিয়ে কমিশন মামলার রায় দিতে পেরেছে মাত্র ৭টি। অভিযোগের অনুসন্ধান করেছে মাত্র ২টি এবং তদন্ত চলমান রেখেছে ৩২টি মামলার। অধিকাংশ মামলায় দৃশ্যমান কোনো শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেনি তারা, অভিযুক্তদের পরামর্শ দিয়ে দায় শেষ করে কমিশন।
বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব প্রতিযোগিতা কমিশনের হলেও তারা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে সভা-সেমিনারে বক্তব্য রেখে দায়িত্ব শেষ করে প্রতিযোগিতা কমিশন। একই অর্থবছরে কমিশন শুধু নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২৯টি বিষয়ে কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা করেছে ৫টি। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সভা করেছে ৬টি। প্রতিযোগিতা কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে কমিশনের উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি, অলিগোপলি অবস্থা, যৌথবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা বিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলকরণ;
উচ্চতর জ্ঞানভিত্তিক গবেষণাধর্মী এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর কমিশন গড়ে তোলা। সভা-সেমিনার হলেও কোথাও বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতে পারেনি প্রতিযোগিতা কমিশন।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য কমিশনকে আট কোটি চুয়ান্ন লক্ষ টাকা বাজেট দেয় অর্থ বিভাগ। এর মধ্যে শুধু গবেষণার জন্য ব্যয় করা হয়েছে তেরো লক্ষ টাকা। কিন্তু সেই গবেষণার কোনো প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য দৃশ্যগোচর হয়নি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া আজকের বাংলাকে বলেন, ব্যবসায় প্রতিযোগিতা আনা ও মনোপলি ব্যবসা প্রতিহত করার জন্যই সরকার প্রতিযোগিতা কমিশন তৈরি করেছিল। কিন্তু এই কমিশনের ন্যূনতম কোনো কার্যকরী ভূমিকাও আমরা দেখছি না। আগে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত চেয়ারম্যান ছিলেন, তার সময় কোনো কাজ হয়নি। নতুন একজন এসেছেন, তিনিও ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন তিনি আগের দুর্বলতা অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করবেন। কিন্তু তারপর আর কোনো কার্যক্রম দেখি না। আমরা চাই না এই কমিশন বন্ধ হয়ে যাক। অন্তত বর্তমান যা জনবল রয়েছে, তা দিয়েই সামর্থ্য অনুযায়ী কমিশনকে কার্যকর করা হোক।
সরেজমিনে রাজধানীর কাওরান বাজার ও হাতিরপুল কাঁচাবাজার ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে ন্যূনতম কোনো কার্যক্রম নেই প্রতিযোগিতা কমিশনের। তারা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার মনিটরিং দলকে কার্যক্রম চালাতে দেখলেও কখনোই দেখেনি প্রতিযোগিতা কমিশনকে। খুচরা ও পাইকারি একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এরকম কোনো কমিশনের তারা নামও শোনেনি। তারা বলেন, তবে কমিশন বলছে ভিন্ন কথা। কমিশনের এক সদস্য আজকের বাংলাকে জানান, তারা শুধুমাত্র সাপ্লাই সাইডটা দেখেন। ভোক্তাদের দিক থেকে বাজার মনিটরিং করার দায়িত্ব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত বিষয়ে প্রচার-প্রকাশনার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির দায়িত্ব প্রতিযোগিতা কমিশনের। কিন্তু এখানেও তারা কাজ করতে চায় না। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রচারের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হলেও সেখানে তেমন কার্যক্রমে নেই কমিশন। একটি দায়সারা ফেসবুক পেজ খুঁজে পাওয়া গেলেও কোনো কার্যক্রম নেই। চলতি বছরে তারা মাত্র একটি পোস্ট করেছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা মাত্র একটি অভিযানের দৃশ্যের ছবি প্রকাশ করেছে। সেই অভিযানেও নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় করেই দায়িত্ব শেষ করেন তারা। এবছর শুধুমাত্র ৪টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েই সচেতনতা তৈরি করেছে সরকারের এই কমিশন।
তবে সিন্ডিকেটের পেছনে সরকারি নজরদারির অভাব ও ব্যবসার সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন উদ্যোক্তা অর্থনীতিবিদ, ব্যবস্থাপনা পরামর্শক ও লেখক মোহাম্মদ আমান উল্লাহ আমান। তিনি আজকের বাংলাকে বলেন, দেশে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না কারণ এদেশের বিজনেস কালচারটা নষ্ট হয়ে গেছে। এদেশে যারা বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তা তাদের অধিকাংশই ব্যবসা নৈতিকতা চর্চা করে না। আবার আমাদের অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসা শিক্ষার শিক্ষকদেরও কখনোই দেখিনা ব্যবসা সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে এটা নিয়ে কথা বলতে। আর সরকারের কথা কী বলবো? আমি দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করি। এদেশে বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বজায় রাখার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে, সেটা আজকে প্রথম শুনলাম। আপনি সৌভাগ্যবান যে আপনি জানেন, তবে তাদের যদি দৃশ্যমান কার্যক্রম থাকতো, তাহলে তো অবশ্যই দেখতাম।